স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি
বীরশন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের চিন্তাধারায় বেদ-উপনিষদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। সুতরাং, তাঁর চিন্তাধারায় যে আধ্যাত্মিকতার প্রভাব থাকবে, তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। তিনি ছিলেন একাধারে জ্ঞানযোগী, কর্মযোগী, ধ্যানযোগী এবং ভক্তিযোগী। এজন্য তাঁর চিন্তাধারায় জ্ঞান, কর্ম, ধ্যান এবং ভক্তি-এই চারটি বিষয়েরই সমন্বয় ঘটেছে।
এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মতা:
স্বামী বিবেকানন্দ যে বেদান্তের ভাবধারায় প্রভাবিত তাতে কোনো সন্দেহই নেই। সেকারণেই বলা যায় যে, বেদান্তের আলোকে বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা প্রতিফলিত। স্বামী বিবেকানন্দ বেদান্তের অদ্বৈতবাদের ওপর নতুন করে আলোকপাত করেছেন। বেদান্তের ধ্যানধারণাকে কীভাবে আমাদের ব্যাবহারিক জীবনে প্রয়োগ করতে হয় তার শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছেন। তিনি মনে করেন যে, বেদান্তের দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ এবং বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রভৃতি হল আধ্যাত্মিক সাধনার তিনটি স্তর। তত্ত্বমসি (তুমি অর্থাৎ জীবই সেই ব্রহ্ম) অথবা 'অহংব্রহ্মাস্মি' (আমিই ব্রহ্মস্বরূপ)-এরূপ উপনিষদীয় মহাবাক্যগুলিই হল আমাদের আধ্যাত্মিক উপলব্ধির মূল ও শেষ কথা। সুতরাং, আমরা সাধনার যে পথেই এগিয়ে যাই না কেন, এক ও অদ্বিতীয় ব্রন্থের সঙ্গে একাত্মতাই হল আমাদের আধ্যাত্মিক উপলব্ধির শেষ কথা।
নির্ভীক ও শ্রদ্ধা ভাবের জাগরণ:
বিবেকান্দের আধ্যাত্মিক চিন্তাধারা গঠিত হয়েছে কিয়দংশে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রভাবে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃয় তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে আধ্যাত্মিক উপদেশের মাধ্যমে আত্মার অমরত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আত্মার অমরত্বের কথা বলে তিনি অর্জুনকে ক্লৈব্য তথা ক্লীবতা পরিত্যাগ করে নির্ভীক বা ভয়শূন্য হওয়ার কথা বলেছেন। গীতার এরূপ উপদেশ স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক চেতনাকে সুদৃঢ় করেছে। আবার, কঠোপনিষদের শ্রদ্ধাবান ও বীর্যবান নচিকেতার চরিত্রই স্বামী বিবেকানন্দকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। কঠোপনিষদ অনুযায়ী পিতার যজ্ঞকালে বালক নচিকেতার শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়েছিল। স্বামীজির মতে, এই শ্রদ্ধা কথাটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এখানে শ্রদ্ধা বলতে বোঝানো হয়েছে, সংকল্পসাধনে দৃঢ় ও অবিচল নিষ্ঠা, যা মানুষকে প্রলোভন জয় করতে শিক্ষা দেয়। এরূপ শিক্ষা আত্মার দৃঢ়তাকেই সূচিত করে, যার দ্বারা মানুষ তার আধ্যাত্মিক উপলব্ধিগত সত্য থেকে কখনোই বিচ্যুত হয় না।
প্রেয় অপেক্ষা শ্রেয়কেই অধিক গুরুত্বদান:
উপনিষদীয় চিন্তাধারার প্রভাবেও স্বামী বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত। উপনিষদে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আত্মার দৃঢ়তা ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বালক নচিকেতা যমরাজের কাছে পরলোকের রহস্য জানতে চেয়েছিলেন। যমরাজ তাঁকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করলেও নচিকেতা প্রেয়র পরিবর্তে শ্রেয়কেই কামনা করেছেন। কারণ, কাম্যবস্তু হিসেবে প্রেয় যেখানে ঐহিক সুখকে সূচিত করে, শ্রেয় সেখানে পারমার্থিক সুখকেই নির্দেশ করে। ঐহিক সুখ তথা প্রেয় হল ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু পারমার্থিক সুখ তথা শ্রেয় হল চিরস্থায়ী। যমরাজ নচিকেতার আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসার প্রশংসা করে তাঁকে আত্মতত্ত্ব লাভের উপায় বিবৃত করেছেন। নচিকেতাকে উপদেশ দিয়ে যমরাজ বলেছেন- উত্থিত হও। মোহনিদ্রা ত্যাগ করে জাগ্রত হও। শ্রেষ্ঠ আচার্যগণের নিকট গমন করে আত্মতত্ত্ব জ্ঞাত হও (উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত)। স্বামী বিবেকানন্দও তাই প্রেয়র বদলে শ্রেয়তেই গুরুত্বারোপ করেছেন।
আত্ম বা ব্রহ্মজ্ঞানই মানুষের একমাত্র কাম্য:
অদ্বৈত বেদান্তের দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিও প্রভাবিত। স্বামী বিবেকানন্দও এই উপনিষদ বাণীর প্রতিধ্বনি করে বলেছেন যে, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, নির্ভীকতা এবং মোক্ষই হল সাধকের চরম ও পরম কাম্য। অর্থাৎ, আত্মজ্ঞানই অধ্যাত্মজীবনের চরম ও পরম কাম্য। এরূপ আধ্যাত্মিক চেতনা লাভ করলে মানুষের আর কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না। স্বামী বিবেকানন্দের এই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিই সারা পৃথিবীর মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।