১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকায় তীব্র অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয় যা শীঘ্রই ইউরোপ তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই অর্থনৈতিক সংকট 'মহামন্দা' নামে পরিচিত।
মহামন্দার কারণ
১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হওয়ার বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন-
[1] উৎপাদন বৃদ্ধি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে আমেরিকায় খনিজ সম্পদ এবং শিল্প উৎপাদন প্রচুর বৃদ্ধি পায়। উৎপাদিত এই বিপুল পরিমাণ পণ্য শুধু নিজের দেশে বিক্রি করা সম্ভব ছিল না। ফলে প্রচুর শিল্পসমাগ্রী উদ্বৃত্ত হয়ে পড়ে এবং শিল্পপতিরা উৎপাদনের হার যথেষ্ট কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
[2] রপ্তানি হ্রাস: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও তার আগে ইউরোপে আমেরিকায় উৎপাদিত শিল্পদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্য বিক্রির ভালো বাজার ছিল। কিন্তু যুদ্ধের পরবর্তীকালে ইউরোপীয় দেশগুলি নিজেরাই শিল্পসামগ্রী ও ভোগ্যপণ্য উৎপাদন করতে থাকে। ফলে ইউরোপে মার্কিন পণ্য রপ্তানি যথেষ্ট হ্রাস পেয়ে মার্কিন অর্থনীতি বড়ো ধাক্কা খায়।
[3] শিল্পসংস্থার নিয়ন্ত্রণ: বিংশ শতকের শুরু থেকে আমেরিকার উৎপাদন ব্যবস্থায় ছোটোখাটো উৎপাদকদের গুরুত্ব হ্রাস পায় এবং দেশের যাবতীয় উৎপাদন মুষ্টিমেয় কয়েকটি শিল্পসংস্থার হাতে কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। বিশ্বের বাজারে এইসব শিল্পজাত পণ্যগুলির চাহিদা কমায় শিল্পসংস্থাগুলি উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে কর্মী ছাঁটাই শুরু করলে দেশে বেকার-সমস্যা তীব্র হতে থাকে।
[4] কৃষকদের দুর্দশা: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাজারে কৃষিপণ্যের চাহিদা ও মূল্য উভয়ই দ্রুত কমতে থাকে। ফলে কৃষকরা সীমাহীন অর্থনৈতিক দুর্দশার শিকার হয়। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি না হওয়ায় বা পণ্য বিক্রি করে যথার্থ দাম না পাওয়ায় কৃষকরা তাদের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়।
[5] শেয়ার বাজারে ধস: ১৯২০-র দশকে বহু মার্কিন নাগরিক শেয়ার বাজারে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বাজারে শেয়ারের দাম ক্রমশ কমতে থাকে। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর আমেরিকার শেয়ার বাজারে ভয়ানক ধস নামে। ফলে মার্কিন অর্থনীতি সংকটের সম্মুখীন হয়।
[6] স্বর্ণ-সংকট: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপের বহু দেশ নিজের দেশের সোনা আমেরিকায় রপ্তানির বিনিময়ে আমেরিকা থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ক্রয় করে। এভাবে ইউরোপের সোনা আমেরিকায় চলে যায়। কিন্তু যুদ্ধের পর বহু দেশ আমরিকা থেকে আমদানি বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের দেশের সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু প্রেরণ বন্ধ করে। ফলে মার্কিন অর্থনীতির ক্ষতি হয়।
[7] শুল্ক-হার: আমেরিকা নিজের উৎপাদিত সামগ্রীর বিক্রি বাড়ানোর
উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে আমেরিকায় আসা পণ্যের ওপর অত্যধিক হারে শুল্ক চাপিয়ে দেয়। ফলে সেসব পণ্যের মূল্য বেড়ে গিয়ে আমেরিকায় এর বিক্রি কমে যায়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশও একইভাবে আমেরিকা থেকে আসা পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক চাপালে ইউরোপে মার্কিন পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে তার বিক্রি ব্যাহত হয়। ফলে আমেরিকা থেকে পণ্য রপ্তানি কমে যায়। এই অবস্থায় মালিকরা উৎপাদন বন্ধ করলে কলকারখানাগুলি বন্ধ হয় ও বহু মানুষ বেকার হয়।
মূল্যায়ন: ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মহামন্দা আমেরিকায় চরম সংকটের সৃষ্টি করে। আমেরিকায় ব্যাংক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। ব্যাংক থেকে নিজেদের গচ্ছিত টাকা ফেরত না পেয়ে বহু আমানতকারী নিঃস্ব হয়। শিল্প-বাণিজ্যের প্রভূত ক্ষতি হলে দেশে তীব্র বেকার সমস্যা দেখা দেয়। এই মন্দা আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ওপর বহুমুখী প্রভাব ফেলে। ঐতিহাসিক ই এইচ কার বলেছেন যে, এর ফলে 'অর্ধেক ইউরোপ দেউলিয়া হয়ে যায় এবং বাকি অর্ধেক দেউলিয়া হওয়ার অবস্থার সম্মুখীন হয়।'
Read more