728×90 ads

উপমান কী? উপমিতি জ্ঞানের লক্ষণ ও প্রকার আলোচনা করো।

উপমান

ন্যায় মতে, চারপ্রকার প্রমাণের অন্যতম হল উপমান। উপমানও তাই যথার্থ জ্ঞানলাভের একটি উপায় বা প্রমাণরূপে গণ্য। উপমান শব্দটি উপ এবং মান শব্দদ্বয়ের সংযোগে উৎপন্ন, উপ + মান = উপমান। উপ শব্দের অর্থ হল সাদৃশ্য এবং মান শব্দের অর্থ হল জ্ঞান। সুতরাং বলা যায় যে, উপমান শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল সাদৃশ্যের জ্ঞান। উপমিতি নামক জ্ঞানের কারণই হল উপমান। সেজন্যই 'তর্কসংগ্রহ'-এ বলা হয়েছে উপমিতিকরণমুপমানম্। 

মহর্ষি গৌতমের সংজ্ঞা: মহর্ষি গৌতম তাঁর ন্যায়সূত্রে উপমানের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন, প্রসিদ্ধসাধৰ্ম্মাৎ সাধ্যসাধনমুপমানম্। অর্থাৎ, প্রসিদ্ধ কোনো পদার্থের সঙ্গে সাদৃশ্যের মাধ্যমে কোনো সাধ্য পদার্থের যথাযথ নিশ্চয়ের উপায়ই হল উপমান প্রমাণ। প্রসিদ্ধ শব্দের অর্থ হল প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত পদার্থ। প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত কোনো পূর্ব বস্তুর সঙ্গে নতুন কোনো সাধ্য বস্তুর সাদৃশ্য পর্যবেক্ষণ করে, সেই বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানলাভের প্রণালী বা উপায়ই হল উপমান। এরূপ উপায়ের দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞানই হল উপমিতি।

অন্নভট্টের সংজ্ঞা: প্রখ্যাত নৈয়ায়িক অন্নভট্ট তাঁর 'তর্কসংগ্রহ'-এ উপমানের লক্ষণ প্রসঙ্গে বলেছেন সংজ্ঞাসংজ্ঞিসম্বন্ধজ্ঞানমুপমিতিঃ। তৎকরণম্ সাদৃশ্যজ্ঞানম্ অর্থাৎ, সংজ্ঞা এবং সংজ্ঞির মধ্যে সম্বন্ধ বিষয়ক জ্ঞানই হল উপমিতি। এই উপমান জ্ঞানের কারণ হল সাদৃশ্য জ্ঞান। সংজ্ঞা শব্দের অর্থ হল নাম এবং সংজ্ঞি শব্দের অর্থ হল নামি। নাম হল বাচক এবং নামি তার বাচ্য। সুতরাং, সংজ্ঞা-সংজ্ঞির তথা নাম ও নামির বাচ্য-বাচক সম্বন্ধের জ্ঞানই হল উপমিতি। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় যে, কোনো ব্যক্তি গবয় শব্দের বাচ্যার্থ জ্ঞাত না হয়েই কোনো অরণ্যবাসীর কাছে গবয় গোসদৃশ এরূপ শুনে অরণ্যে গমন পূর্বক গোসদৃশ পশুকে দেখে উপমানের মাধ্যমে তার এরূপ জ্ঞান জন্মায় যে, এই দৃষ্ট পশুটি হল গবয়। অর্থাৎ বলা যায় যে, উপমিতির মাধ্যমেই ব্যক্তিটি বুঝতে সমর্থ হয় যে, দৃষ্ট পশুটি গবয় শব্দের বাচ্য। 

উপমিতি জ্ঞানের লক্ষণ ও প্রকার


ত্রিবিধরূপে উপমিতি: ন্যায় মতে, প্রসিদ্ধ পদার্থের সাধ্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যেমন উপমিতি জ্ঞান সম্ভব হয়, তেমনই বৈধর্য্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও উপমিতি জ্ঞান লাভ করা সম্ভব। আবার কোনো কোনো সময় বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও উপমিতি জ্ঞান সম্ভব হতে পারে। এজন্যই সাধর্য্য, বৈধর্য্য এবং বিশেষধর্ম ভেদে উপমিতি জ্ঞানকে ত্রিবিধরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। সাধ্য, বৈধর্য্য এবং বিশেষধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে নৈয়ায়িকগণ যথাক্রমে-[i] সাদৃশ্য উপমিতি, [ii] বৈসাদৃশ্য উপমিতি এবং [iii] অসাধারণ বিশেষ ধর্মবিশিষ্ট উপমিতি জ্ঞানের উদ্ভব ঘটে বলে উল্লেখ করেন। গো-এর সঙ্গে গবয়-এর সাদৃশ্য হেতু গবয় গোসদৃশ- এরূপ সাদৃশ্য উপমিতির জ্ঞান হয়। আবার, অশ্ব এবং গোরুর ক্ষুরাকৃতির বৈধর্য্যের জন্য অশ্ব এবং গোরুর বৈধ্যরূপ বৈসাদৃশ্য উপমিতি জ্ঞানও উৎপন্ন হয়। আবার, যে জন্তুর নাসিকার ওপর খর্গ বা খাঁড়া থাকে তাকে বলা হয় গণ্ডার। এরূপ অতিদেশ বাক্য শ্রবণের পর যদি কোনো ব্যক্তি কোনো জন্ডুর মধ্যে উক্ত বিশেষ ধর্মটি পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হয়, তাহলে সেই জন্তুটি যে গণ্ডাররূপে গণ্য হবে, এরূপ উপমিতির জ্ঞান সম্ভব হয়। এরূপ উপমিতির জ্ঞানকেই বলা হয় অসাধারণ ধর্মবিশিষ্ট উপমিতি জ্ঞান।

পূর্বশর্তের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন ও নব্যদের মধ্যে ভেদ: উপমিতি জ্ঞানের ক্ষেত্রে যে-সমস্ত পূর্বশর্ত পরিলক্ষিত হয়, সেগুলির পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন নৈয়ায়িক এবং নব্য নৈয়ায়িকদের মধ্যে অবশ্য মতভেদ দেখা যায়। প্রাচীনপন্থীরা দাবি করেন যে, অতিদেশ বাক্যার্থ জ্ঞান অর্থাৎ, অতিদেশ ব্যক্তির যথার্থ বাক্যই হল উপমিতি জ্ঞানের মূল কারণ এবং সাদৃশ্য-জ্ঞান হল তার সহকারী কারণ। কিন্তু নবীনপন্থীরা এরূপ মত স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, উপমিতি জ্ঞানের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য জ্ঞানই হল আসল কারণ এবং অতিদেশ বাক্যার্থ জ্ঞান হল তার সহকারী কারণ। অবশ্য উপমিতির কারণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন ও নব্যদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও, কারণের ব্যাপার সম্পর্কে উভয় পন্থীরাই ঐক্যমত পোষণ করেন। কারণ, উভয়পন্থীরাই দাবি করেন যে, অতিদেশ বাক্যার্থস্মরণ হল ব্যাপার এবং তার অব্যবহিত পূর্ববর্তী উপস্থিতির জন্যই উপমিতি জ্ঞান সম্ভব হয়।

উপমান সম্পর্কে অপরাপর সম্প্রদায়গুলির অভিমত: উপমানকে প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করার ফলে ন্যায়দার্শনিকদের সঙ্গে অপরাপর ভারতীয় দার্শনিকদের একটি পার্থক্য দেখা যায়। কারণ, চার্বাকগণ উপমানকে প্রমাণ হিসেবে আদৌ স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ এবং প্রত্যক্ষ ছাড়া কোনো প্রমাণই গ্রাহ্য নয়। বৌদ্ধ মতে, উপমান স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে গ্রাহ্য হতে পারে না। তাঁরা উপমানকে প্রত্যক্ষ ও শাব্দজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। জৈন দার্শনিকগণ উপমানকে প্রত্যভিজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করেন। বৈশেষিক এবং সাংখ্য সম্প্রদায় উপমানের স্বাতন্ত্র্য দাবি না করে, তাকে অনুমানের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। আবার, মীমাংসা ও বেদান্ত সম্প্রদায় উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে দাবি করলেও তাঁদের ব্যাখ্যা কিন্তু নৈয়ায়িকদের সাদৃশ্য নয়। সুতরাং, ন্যায়দার্শনিকগণ যেভাবে উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে উল্লেখ করেছেন, সেভাবে কিন্তু অপরাপর ভারতীয় দার্শনিক সম্প্রদায়গুলি করেনি।

Post a Comment

0 Comments