Ad Code

কান্টের বিচারবাদের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

কান্টের বিচারবাদ


জ্ঞানের উৎপত্তি সংক্রান্ত মতবাদগুলির মধ্যে কান্টের বিচারবাদ হল একটি অন্যতম দার্শনিক মতবাদ। জ্ঞানের উৎপত্তির বিষয়ে কান্টের বিচারবাদের পূর্বে বুদ্ধিবাদ (rationalism) এবং অভিজ্ঞতাবাদের (empiricism) পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু এই দুটি মতবাদই হল চরমপন্থী ও একদেশদর্শী মতবাদরূপে গণ্য। জ্ঞানের উৎপত্তির বিষয়ের এই দুটি মতবাদ কখনোই সন্তোষজনক নয়। কারণ, বুদ্ধিবাদ কেবল বুদ্ধিকেই জ্ঞানের মৌল উৎসরূপে স্বীকার করেছে এবং অভিজ্ঞতাকে অস্বীকার করেছে। অপরদিকে, অভিজ্ঞতাবাদ কেবল ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাকেই জ্ঞানের মৌল উৎসরূপে উল্লেখ করেছে এবং বুদ্ধির ভূমিকাকে অস্বীকার করেছে। ফলত এই দুটি জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদই নির্বিচারবাদে পরিণত হয়েছে। দার্শনিক কান্ট জ্ঞানের উৎস সম্পর্কিত এই দুটি মতবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে বিচারবাদ (critical theory)- এর সূচনা করেছেন।

কান্টের জ্ঞানতাত্ত্বিক চিন্তাধারার তিনটি পর্যায়: 


কান্টের জ্ঞানোৎপত্তির চিন্তাধারার বিকাশের ক্ষেত্রে মোটামুটি তিনটি পর্যায় পরিলক্ষিত হয়। প্রথম পর্যায়ে তিনি অধিবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রখ্যাত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লাইবনিজ ও ভলফের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন। এই পর্যায়ের শেষের দিকে অবশ্য তিনি বুদ্ধিবাদের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে তিনি প্রখ্যাত অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এই পর্যায়কে তিনি উপলব্ধি করতে সমর্থ হন যে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের প্রাথমিক উৎস। তিনি আরও উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছিলেন যে, হিউমই তাঁকে বিচার-বিযুক্ত মোহনিদ্রা থেকে জাগ্রত করেছে। আর তৃতীয় তথা শেষ পর্যায়ে কান্ট বিশুদ্ধ বুদ্ধির বিচারমূলক দর্শন (critical philosophy)-এর প্রবর্তন করেন। তাঁর এরূপ প্রয়াসটি 1718 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত 'Critique of Pure Reason' গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়।

বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বিত আকার হিসেবে বিচারবাদ: 


প্রখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট তাঁর বিচারবাদে বুদ্ধিবাদ এবং অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে এক সুচারু সমন্বয়সাধন করার চেষ্টা করেছেন। জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার অবদানকে তিনি নানাভাবে বিচারবিশ্লেষণ করে উভয়কেই জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে আবশ্যিক শর্তরূপে উল্লেখ করেছেন। তিনি একান্ত নিরপেক্ষভাবে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার সামর্থ্য, শর্ত, সীমা ও সম্ভাবনা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা করেই তাঁর নিজস্ব মতবাদে উপনীত হয়েছেন। সেকারণেই জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক কান্টের মতবাদকে বিচারবাদ (critical theory) রূপে গণ্য করা হয়। 

জ্ঞানের উপাদান ও আকার: 


কান্ট বিচারবিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেছেন যে, জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধির একটা ভূমিকা আছে ঠিকই, কিন্তু সেটাই সব কিছু নয়। একইভাবে জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতারও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে ঠিকই, কিন্তু শুধু ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের চরম ও পরম উৎসরূপে গণ্য হতে পারে না। বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতা তাই উভয়েই একদেশদর্শী মতবাদরূপে গণ্য। তিনি দাবি করেন যে, আমাদের জ্ঞান উৎসারিত হতে পারে বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতার এক সুচারু সমন্বয়ে। তাঁর মতে, ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা আমাদের জ্ঞানের উপাদান (matter) সরবরাহ করে, আর বুদ্ধি সেই সমস্ত উপাদানের ওপর আকার (form) প্রয়োগ করে জ্ঞানের সৃষ্টি করে।

কান্টের সিদ্ধান্ত: কান্টের মতানুসারে, মানুষের মন বাইরে থেকে

ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সংবেদন গ্রহণ করে। এই সংবেদনগুলি পারস্পরিকভাবে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন। কান্ট এগুলির নাম দিয়েছেন বিভিন্ন প্রকারের ইন্দ্রিয়ানুভূতি (manifold of intuitions)। এগুলিই হল জ্ঞানের মৌল উপাদান। এগুলিকে যেমনভাবে ইন্দ্রিয়ানুভবের মাধ্যমে পাওয়া যায়, ঠিক তেমনভাবে যদি গ্রহণ করা যায়, তাহলে সেগুলির কোনো অর্থ থাকে না। এর ফলে নিছক এগুলি কোনো জ্ঞান দিতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন হল আকার প্রদান (formalisation)। আর আমাদের বুদ্ধি বা প্রজ্ঞাই এরূপ কাজটি সম্পন্ন করে। সুতরাং, আকারবর্জিত উপাদান অন্ধ বা সুনির্দিষ্ট কোনো কিছুই নয়, আবার উপাদানবর্জিত আকারও নিছকই শূন্য (Percept without concept is blind and concept without percept is empty)।