ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের পতন ও রাজার মৃত্যুদণ্ডের পর দেশে এক সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের বিপ্লবী নেতারা দেশে এক আপৎকালীন জরুরি শাসন চালু করে যা সন্ত্রাসের রাজত্ব নামে পরিচিত।
সন্ত্রাসের শাসনের ফলাফল
ফ্রান্সে দীর্ঘ ১৩ মাস ব্যাপী (জুন, ১৭৯৩- জুলাই, ১৭৯৪ খ্রি.) সন্ত্রাসের শাসনের ফলাফলগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যেমন-
[1] বিপ্লব রক্ষা : সন্ত্রাসের শাসনের দ্বারা ফ্রান্সের প্রতিবিপ্লব অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, গৃহযুদ্ধ, অরাজকতা প্রভৃতি বন্ধ হয়। বৈদেশিক আক্রমণের হাত থেকেও বিপ্লবী ফ্রান্স রক্ষা পায়।)
[2] হত্যালীলা: প্রতিবিপ্লব দমন করে ফ্রান্সকে রক্ষা করতে গিয়ে নির্বিচারে বহু নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ গিলোটিনে প্রাণ হারান এবং ৩ লক্ষ মানুষ বন্দি হন। লয়ার নদীতে ডুবিয়ে অনেককে হত্যা করা হয়। বহু মানুষ চিরদিনের মতো নিখোঁজ হয়ে যান। রানি মারি আঁতোয়ানেত, মাদাম রোঁলা, ব্রিসো, বারনাভ, বেইলি, দাঁতোঁ প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিরও মৃত্যুদণ্ড হয়
[3] প্রগতিশীল সংস্কার: সন্ত্রাসের শাসনকালে ফ্রান্সে বহু প্রগতিশীল সংস্কার চালু হয়। যথা- ফ্রান্সের সমাজ থেকে 'পুরাতনতন্ত্র' ও সামাজিক বৈষম্য সম্পূর্ণ নির্মূল করে 'সাম্য' প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। [i] দেশত্যাগী অভিজাত বা এমিগ্রিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিলি করা হয়। [iii] জাতীয় সেনাদলে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়।
[iv] খাদ্যদ্রব্যের সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়া হয়। পিতার সম্পত্তিতে সকল সন্তানের সমান অধিকার স্বীকৃত হয়।প) শিশু, বৃদ্ধা ও অসহায় বিধবাদের সরকারি সহায়তা দানের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
সিন্ত্রাসের শাসনের গ্রহণযোগ্যতা বিচার
কোনো কোনো ঐতিহাসিক সন্ত্রাসের শাসনের বিপক্ষে যুক্তি দিলেও কেউ কেউ আবার এই শাসনের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।
সন্ত্রাসের বিপক্ষে যুক্তি: ঐতিহাসিক তেইন সন্ত্রাসের শাসনের সমালোচনা করেছেন। তার মতানুযায়ী এর বিপক্ষে যুক্তিগুলি হল-
[i] বিপ্লবীর বলিদান: বহু প্রকৃত বিপ্লবী সন্ত্রাসের বলি হন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক বলেন যে, "সন্ত্রাসের দ্বারা বিপ্লব তার নিজের সন্তানদের গিলে ফেলে।"
[ii] অতিসক্রিয়তা: দেশের সংকটকালে সন্ত্রাসের কিছুটা প্রয়োজন থাকলেও সন্ত্রাস পরিচালনায় অকারণ অতিসক্রিয়তা দেখায়।
[iii) সাধারণ মানুষের মৃত্যু: সর্বহারা বহু মানুষ সন্ত্রাসের বলি হন। বহু নিরপরাধ ও নিরীহ মানুষ বিনা বিচারে প্রাণ হারান।
[IV] উচ্ছৃঙ্খলতা: সন্ত্রাসের শাসনের সুযোগে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা সরকারি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়।)
[V] গণতন্ত্র ধ্বংস: সন্ত্রাস ফ্রান্সের গণতন্ত্র ধ্বংস করে। এই শাসনা ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আইনের শাসন ধ্বংস করে
[2] সন্ত্রাসের পক্ষে যুক্তি: ওলার, মাতিয়ে, লেফেভর প্রমুখ ঐতিহাসিক সন্ত্রাসের শাসনের সপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি দিয়েছেন। যথা-
[i]আপৎকালীন পদক্ষেপ: ফ্রান্স অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয়ক্ষেত্রে সংকটের সম্মুখীন হলে সন্ত্রাস ছাড়া পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না।
[ii]বিপ্লব রক্ষা: সন্ত্রাসের শাসনের ফলে ফ্রান্সে অরাজকতা দূর হয় এবং শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসে। বৈদেশিক আক্রমণের সম্ভাবনা থেকেও ফ্রান্স রক্ষা পায়। এককথায়, সন্ত্রাসের দ্বারা বিপ্লব রক্ষা পায়।
[iii] জনকল্যাণ: সন্ত্রাসের শাসনকালে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, সর্বনিম্ন মজুরি, ভূমিহীনদের জমি বিলি প্রভৃতি বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক আইন পাস করা হয়।)
[iv] অতিরঞ্জিত বক্তব্য: ডিকেন্স-সহ বিভিন্ন লেখক সন্ত্রাসের ভয়াবহতাকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করেছেন
মূল্যায়নঃ ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সংকট দূর করার জন্য সন্ত্রাসের শাসনকে সমর্থন করা যায়। কিন্তু সন্ত্রাস অহেতুক বাড়াবাড়ি করায় জনগণ বিপ্লবের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। ফলে জ্যাকোবিন দল জনসমর্থন হারায় এবং ফ্রান্সে নেপোলিয়নের 'স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রস্তুত হয়।