প্রসক্তি সম্বন্ধ কাকে বলে? কারণ ও কার্য বিষয়ে প্রসক্তি তত্ত্ব সমালোচনা-সহ ব্যাখ্যা করো।

প্রসক্তি সম্বন্ধ

কার্যকারণ সম্পর্কে বুদ্ধিবাদীদের অভিমতকে আবশ্যিক বা অবশ্যম্ভব মতবাদরূপে উল্লেখ করা হয়। এরূপ অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে যে, কার্যের ধারণাটি অনিবার্য বা আবশ্যিকভাবে কারণের ধারণা থেকে নিঃসৃত হয়। অর্থাৎ, কারণ ও কার্যের মধ্যে একপ্রকার আবশ্যিকতার সম্পর্ক আছে। কারণ ও কার্যের মধ্যে এই আবশ্যিকতার সম্বন্ধটি কীরূপ তা বোঝাতে গিয়েই প্রখ্যাত বুদ্ধিবাদী দার্শনিক ইউয়িং কার্যকারণের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে প্রসক্তি সম্বন্ধের বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন।

কারণ ও কার্য বিষয়ে প্রসক্তি তত্ত্ব


প্রসক্তি সম্বন্ধ হল এমনই একপ্রকার অনিবার্যতার সম্বন্ধ যা একটি বৈধ অবরোহ যুক্তির ক্ষেত্রে দেখা যায়। কারণ, যে-কোনো বৈধ অবরোহ যুক্তির ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, সিদ্ধান্তটি অনিবার্যভাবে যুক্তিবাক্য থেকে নিঃসৃত হয়। সেক্ষেত্রে যুক্তিবাক্য এবং সিদ্ধান্তের সম্বন্ধটি একপ্রকার আবশ্যিক সম্বন্ধরূপে গণ্য। বৈধ অবরোহ যুক্তিতে যদি যুক্তিবাক্যগুলি সত্যরূপে গ্রাহ্য হয় তবে তা থেকে একটি সত্য সিদ্ধান্ত নিঃসৃত না হয়ে পারে না অর্থাৎ, যুক্তিবাক্য থেকে সিদ্ধান্তটি অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়। এরূপ বিষয়ের কোনো ব্যতিক্রম হতে পারে না। অনুরূপভাবে বলা যায় যে, কারণের ধারণাটি থেকেও অনিবার্যভাবে কার্যের ধারণাটি নিঃসৃত হয়। কার্য নামক ঘটনাটি আছে অথচ তা কোনো কারণ থেকে নিঃসৃত নয়-এমনটি কখনোই হতে পারে না। সুতরাং, কার্য ও কারণের সম্বন্ধটি হল প্রসক্তি সম্বন্ধের অনুরূপ।

প্রসক্তি সম্বন্ধের মূল বক্তব্যকে যেভাবে উল্লেখ করা যায়-

[1] কারণ ও কার্য কখনোই দুটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

[2] এই দুটি ঘটনা একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

[3] কারণের ধারণা থেকে কার্যের ধারণাটি অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়। অর্থাৎ এদের সম্বন্ধটি হল অনিবার্যতার সম্বন্ধ।

[4] কারণ থেকে কার্যের নিঃসরণের বিষয়টি যুক্তিবাক্য এবং সিদ্ধান্তের মধ্যে প্রসক্তি সম্বন্ধের সঙ্গে তুলনীয়। এরূপ সম্বন্ধে তাই কারণকে হেতুরূপে এবং কার্যকে তার ফল বা সিদ্ধান্তরূপে গণ্য করা হয়।

[5] কার্যকারণ সম্বন্ধের ধারণা হল একটি সহজাত ধারণা। এরূপ সহজাত ধারণা আমাদের আছে বলেই আমরা ধারণা দুটিকে পাশাপাশি রেখে তাদের মধ্যে কার্যকারণ সম্বন্ধ নির্ণয় করতে পারি।

[6] যৌক্তিক প্রসক্তির ক্ষেত্রে হেতুবাক্য ও সিদ্ধান্তের মধ্যে কালগত ব্যবধান না থাকলেও, কার্য-কারণ প্রসক্তির ক্ষেত্রেই কালগত ব্যবধান থাকে। 

প্রসক্তি সম্বন্ধের গ্রহণযোগ্যতা


প্রখ্যাত অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক ডেভিড হিউমের আগে পর্যন্ত কোনো দার্শনিক প্রসক্তি সমন্ধ মতবাদটির বিশেষ কোনো সমালোচনা করেননি। কিন্তু হিউম তাঁর অভিজ্ঞতাবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে এরূপ মতবাদটির কঠোর সমালোচনা করেছেন। এ সম্পর্কে হিউমের অভিযোগগুলি হল-

প্রথমত: কার্যকারণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কারণ ও কার্য নামক ঘটনা দুটিকে প্রত্যক্ষ করা যায় ঠিকই, কিন্তু তাদের মধ্যে যে প্রসক্তি বা অনিবার্যতার সম্বন্ধ আছে-তাকে কখনোই প্রত্যক্ষ করা যায় না। এরূপ বিষয়টি তাই কখনোই অভিজ্ঞতার নিরিখে গ্রাহ্য নয়।

দ্বিতীয়ত: কার্য ও কারণের মধ্যে যদি প্রসক্তি বা অনিবার্যতার সম্বন্ধ থেকেই থাকে তাহলে কারণ-কে বিশ্লেষণ করলে কার্য-র ধারণাটি পাওয়া যেত। কিন্তু তা কখনোই পাওয়া যায় না। কারণ, জলকে (কারণ) বিশ্লেষণ করলে আমরা তৃয়া নিবারণের (কার্য) বিষয়টিকে মোটেই পাই না। সুতরাং, প্রসক্তির তত্ত্বটি কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তৃতীয়ত: প্রসক্তিবাদীরা কার্যকারণের সম্বন্ধটিকে বৈধ অবরোহ যুক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন—যা আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, কার্যকারণ সম্বন্ধে বিষয়টি হল অভিজ্ঞতালব্ধ আরোহ অনুমানের বিষয়, কখনোই অবরোহ অনুমানের বিষয় নয়।

চতুর্থত:প্রসক্তিবাদীরা কারণ ও হেতুকে একই অর্থে প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু কারণ ও হেতু কখনোই একই অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে না। হেতু শব্দটি কারণ ছাড়াও, 'যেহেতু', 'এজন্য' প্রভৃতিকেও বোঝাতে পারে। সেকারণেই হেতু শব্দটির ব্যাপ্তি কারণ শব্দ অপেক্ষা অনেক বেশি। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদের অবদান আলোচনা করো।

মাত্র এক ক্লিকেই ছবি থেকে ইমোজি কিভাবে রিমুভ করবেন ?

ব্যাপ্তি কাকে বলে? ব্যাপ্তিগ্রহের উপায় কী?