728×90 ads

কর্মের সঙ্গে কর্তব্য কীভাবে সম্পর্কিত?

কর্মের সঙ্গে কর্তব্যের সম্পর্ক

স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কর্মযোগে উল্লেখ করেছেন যে, কর্মযোগের তত্ত্বকে যথাযথভাবে অনুধাবন করতে হলে আমাদের একান্তভাবে জানা আবশ্যক যে কর্তব্য বলতে আমরা কী বুঝি? তিনি বলেন যে, আমাকে যদি কোনো কিছু করতে হয়, তবে প্রথমেই আমার জানা উচিত এটা আমার কর্তব্য কি না। এরূপ বিষয়টি জানতে পারলে তবেই আমি সেই কাজটি করতে প্রবৃত্ত হব। কারণ, কর্তব্য শব্দটির অর্থই হল কাজটি করা উচিত। অবশ্য এই কর্তব্যজ্ঞান বিভিন্ন ব্যক্তি ও জাতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন। কারণ, হিন্দুরা বেদে নির্দেশিত কর্মসমূহকেই কর্তব্য বলে মনে করে; মুসলমানরা কোরানে নির্দেশিত কর্মকেই কর্তব্য বলে মনে করে; খ্রিস্টানরা বাইবেলে বর্ণিত কর্মসমূহকেই কর্তব্য বলে মনে করে; আবার দেখা যায় যে, ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে কর্তব্যের বিষয়টি ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রতিভাত হয়েছে। সুতরাং, কর্তব্য শব্দটির কোনো সর্বজনীন ও স্পষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।

সাপেক্ষরূপে কর্তব্য: 

স্বামীজি বলেন যে, আমাদের সামনে যখন বিভিন্নরকম ঘটনা ঘটে, তখন আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক অথবা পূর্ব সংস্কার নিষ্কাম কর্ম। এরূপ কর্মের কোনো কর্মফল থাকে না এবং সে কারণেই মানুষকে এই কর্মের জন্য কোনো কর্মফল ভোগ করতে হয় না। নিষ্কাম কর্ম এক আদর্শমূলক কর্ম যা গীতায় স্বীকৃত হয়েছে এবং বিবেকানন্দ তাঁর কর্মযোগের মূল ভিত্তি রূপে উল্লেখ করেছেন এই নিষ্কাম কর্মকে।

বিবেকানন্দের মতে নিষ্কাম কর্ম


স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর 'কর্মযোগ'-এ কর্মের আদর্শগত ব্যাখ্যা দিতে দিয়ে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যে নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হয়েছে, তার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন যে, প্রকৃত কর্মযোগীকে নিষ্কামভাবে কর্ম সম্পাদন করতে হয়। কারণ, যিনি কর্মযোগী রূপে গণ্য, তিনি কখনোই ফলাকাঙ্ক্ষা নিয়ে কর্ম সম্পাদন করেন না। তিনি শুধু কর্মের জন্যই কর্ম সম্পাদন করেন। কর্মযোগীর কর্মসম্পাদনের ক্ষেত্রে তাই কখনোই কামনা-বাসনা থাকা উচিত নয়। কর্মযোগীর শুধু নিরন্তর নিষ্কামভাবে কর্ম করে যাওয়াই উচিত, আর কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ করা উচিত। ঈশ্বরই হলেন আমাদের সমস্তপ্রকার কর্মের নিয়ন্ত্রক, এরূপ বিশ্বাসই কর্মযোগীর থাকা উচিত। গীতায় উল্লেখিত কর্মের এরূপ আদর্শকেই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর কর্মযোগের মূল ভিত্তিরূপে উল্লেখ করেছেন। 

নিষ্কাম কর্মের দ্বারা অনাসক্তি অর্জন: 

কর্মযোগের ষষ্ঠ অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অনাসক্তিই হল পরিপূর্ণ আত্মত্যাগ। বাহ্যবিষয়ে অনাসক্তি অর্জন করতে হলে নিরন্তরভাবে নিষ্কাম কর্ম করতে হবে। নিষ্কামভাবে কর্ম করার ক্ষমতা মানুষ কখনোই একদিনে আয়ত্ত করতে পারে না। ক্রমিক ও নিরন্তর কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে মানুষ ধীরে ধীরে এরূপ শক্তি অর্জন করতে পারে। মানুষ ক্রমে ক্রমে বুঝতে সমর্থ হয় যে, প্রকৃত সুখ হল স্বার্থপরতার বিনাশে। সে কারণেই মানুষের সকাম ও স্বার্থযুক্ত কর্ম করা কখনোই উচিত নয়। অনাসক্তিকে আয়ত্ত করে, দুর্বলতাকে পরিহার করে, মানসিক বলে বলীয়ান হয়ে তবেই কর্মযোগী নিষ্কামভবে কর্ম করতে সমর্থ হয়। 
নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে মুক্তিলাভ
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর 'কর্মযোগ'-এর সপ্তম অধ্যায়ে মুক্তির বিষয়টি আলোচনা করেছেন। বিবেকানন্দের মতে, মানুষের চরম লক্ষ্য হল মুক্তি। মুক্তিলাভের জন্য মানুষ এই সসীমত্বের বাঁধন কেটে সবকিছুর উর্ধ্বে উঠতে চায়। মুক্তির জন্য মানুষ সমস্তপ্রকার আসত্তিকে ত্যাগ করতে চায়। এই আসক্তি ত্যাগের উপায় হল দুটি-নিবৃত্তি মার্গ এবং প্রবৃত্তি মার্গ। নিবৃত্তি মার্গে নেতি নেতি (এটি নয় এটি নয়) করে সব কিছু ত্যাগ করতে হয়। আর প্রবৃত্তি মার্গে (ইতি ইতি করে) সব কিছুকে গ্রহণ করে তবে সেগুলিকে ত্যাগ করতে হয়। সাধারণ মানুষ প্রবৃত্তি মার্গকে মুক্তির পথ হিসেবে বেছে নিলেও মহাপুরুষগণ কিন্তু নিবৃত্তি মার্গকেই মুক্তির পথ বলে মনে করেন। যে পথই অনুসরণ করা হোক-না-কেন, এ কথা ঠিক যে, মুক্তি পেতে গেলে মানুষকে অবশ্যই নিষ্কামভাবে কর্মযোগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে হবে। এরূপ বিষয়টিই বিবেকানন্দ তাঁর কর্মযোগে তুলে ধরেছেন।

Post a Comment

0 Comments